উৎসব
পহেলা বৈশাখ নিয়ে রবীন্দ্র ঠাকুরের কবিতা
পয়লা বৈশাখ বাঙ্গালীদের একটি বাংলা বছরের জাতীয় উৎসব এবং প্রতিবছর এই উৎসবটি বাঙালিরা পালন করে থাকেন। বাঙ্গালীদের জাতীয় ঐতিহ্য ও বাংলা নববর্ষের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য এই সাপটি বাঙালিরা বিভিন্ন ভাবে পালন করেন। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য ও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু কবিতা লিখেছেন যা চির স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়।
সুতরাং আপনি যদি রবি ঠাকুরের সেই কবিতা গুলি অনুসন্ধান করে থাকেন এবং পহেলা বৈশাখের কবিতা আবৃতি করতে চান তাহলে আমাদের ওয়েবসাইট থেকে সহজেই সংগ্রহ করতে পারেন
রবীন্দ্রনাথের পহেলা বৈশাখ কবিতা
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে উপলব্ধি করে রবীনাথ ঠাকুরের কয়েকটি কবিতা লিখেছেন চাপালা বৈশাখের কবিতা হিসেবে পরিচিত। আসুন পয়লা বৈশাখের এই কবিতাগুলি নিচে ধারাবাহিকভাবে পরে নিতে পারি.
১. এসো হে বৈশাখ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ। তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥ যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি, অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি, আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ। মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক॥
২. নববর্ষ এল আজি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যগ্রন্থঃ কড়ি ও কোমল নববর্ষ এল আজি দুর্যোগের ঘন অন্ধকারে; আনে নি আশার বাণী, দেবে না সে করুণ প্রশ্রয়। প্রতিকূল ভাগ্য আসে হিংস্র বিভীষিকার আকারে; তখনি সে অকল্যাণ যখনি তাহারে করি ভয়। যে জীবন বহিয়াছি পূর্ণ মূল্যে আজ হোক কেনা; দুর্দিনে নির্ভীক বীর্যে শোধ করি তার শেষ দেনা।
৩. বৈশাখ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যগ্রন্থঃ কল্পনা হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ! ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল, তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল কারে দাও ডাক হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ! ছায়ামূর্তি যত অনুচর দগ্ধতাম্র দিগন্তের কোন্ ছিদ্র হতে ছুটে আসে! কী ভীষ্ম অদৃশ্য নৃত্যে মাতি উঠে মধ্যাহ্ন-আকাশে নিঃশব্দ প্রখর ছায়ামূর্তি তব অনুচর! মত্তশ্রমে শ্বসিছে হুতাশ। রহি রহি দহি দহি উগ্রবেগে উঠিছে ঘুরিয়া, আবর্তিয়া তৃণপর্ণ, ঘূর্ণচ্ছন্দে শূন্যে আলোড়িয়া চূর্ণরেণুরাশ মত্তশ্রমে শ্বসিছে হুতাশ। দীপ্তচক্ষু হে শীর্ণ সন্ন্যাসী, পদ্মাসনে বস আসি রক্তনেত্র তুলিয়া ললাটে, শুষ্কজল নদীতীরে শস্যশূন্য তৃষাদীর্ণ মাঠে উদাসী প্রবাসী— দীপ্তচক্ষু হে শীর্ণ সন্ন্যাসী! জ্বলিতেছে সম্মুখে তোমার লোলুপ চিতাগ্নিশিখা, লেহি লেহি বিরাট অম্বর, নিখিলের পরিত্যক্ত মৃতস্তূপ বিগত বৎসর করি ভস্মসার। চিতা জ্বলে সম্মুখে তোমার। হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ। উদার উদাস কণ্ঠ যাক ছুটে দক্ষিণে ও বামে, যাক নদী পার হয়ে, যাক চলি গ্রাম হতে গ্রামে, পূর্ণ করি মাঠ। হে বৈরাগী, করো শান্তিপাঠ। সকরুণ তব মন্ত্রসাথে মর্মভেদী যত দুঃখ বিস্তারিয়া যাক বিশ্ব- ’পরে, ক্লান্ত কপোতের কণ্ঠে, ক্ষীণ জাহ্নবীর শ্রান্তস্বরে, অশ্বত্থছায়াতে— সকরুণ তব মন্ত্রসাথে। দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ তোমার ফুৎকারলুব্ধ ধুলা-সম উড়ুক গগনে, ভ’রে দিক নিকুঞ্জের স্খলিত ফুলের গন্ধসনে আকুল আকাশ— দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ। তোমার গেরুয়া বস্ত্রাঞ্চল দাও পাতি নভস্তলে, বিশাল বৈরাগ্যে আবরিয়া জরা মৃত্যু ক্ষুধা তৃষ্ণা, লক্ষকোটি নরনারী-হিয়া চিন্তায় বিকল। দাও পাতি গেরুয়া অঞ্চল। ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ! ভাঙিয়া মধ্যাহ্নতন্দ্রা জাগি উঠি বাহিরিব দ্বারে, চেয়ে রব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে নিস্তব্ধ নির্বাক। হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
৪. পুরাতন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যগ্রন্থঃ কড়ি ও কোমল হেথা হতে যাও, পুরাতন। হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে। আবার বাজিছে বাঁশি, আবার উঠিছে হাসি, বসন্তের বাতাস বয়েছে। সুনীল আকাশ- ‘পরে শুভ্র মেঘ থরে থরে শ্রান্ত যেন রবির আলোকে, পাখিরা ঝাড়িছে পাখা, কাঁপিছে তরুর শাখা, খেলাইছে বালিকা বালকে। সমুখের সরোবরে আলো ঝিকিমিকি করে, ছায়া কাঁপিতেছে থরথর, জলের পানেতে চেয়ে ঘাটে বসে আছে মেয়ে, শুনিছে পাতার মরমর। কী জানি কত কী আশে চলিয়াছে চারি পাশে কত লোক কত সুখে দুখে, সবাই তো ভুলে আছে, কেহ হাসে কেহ নাচে, তুমি কেন দাঁড়াও সমুখে। বাতাস যেতেছে বহি, তুমি কেন রহি রহি তারি মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস। সুদূরে বাজিছে বাঁশি, তুমি কেন ঢাল আসি তারি মাঝে বিলাপ-উচ্ছ্বাস। উঠেছে প্রভাত-রবি, আঁকিছে সোনার ছবি, তুমি কেন ফেল তাহে ছায়া। বারেক যে চলে যায় তারে তো কেহ না চায়, তবু তার কেন এত মায়া। তবু কেন সন্ধ্যাকালে জলদের অন্তরালে লুকায়ে ধরার পানে চায়– নিশীথের অন্ধকারে পুরানো ঘরের দ্বারে কেন এসে পুন ফিরে যায়। কী দেখিতে আসিয়াছ! যাহা কিছু ফেলে গেছ কে তাদের করিবে যতন। স্মরণের চিহ্ন যত ছিল পড়ে দিন-কত ঝরে-পড়া পাতার মতন আজি বসন্তের বায় একেকটি করে হায় উড়ায়ে ফেলিছে প্রতিদিন ধূলিতে মাটিতে রহি হাসির কিরণে দহি ক্ষণে ক্ষণে হতেছে মলিন। ঢাকো তবে ঢাকো মুখ, নিয়ে যাও দুঃখ সুখ, চেয়ো না চেয়ো না ফিরে ফিরে। হেথায় আলয় নাহি, অনন্তের পানে চাহি আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে।
৫. নববর্ষে – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্যগ্রন্থঃ চিত্রা নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত! আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন করিলাম নত। বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও, ক্ষমা করো আজিকার মতো পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত। আজি বাঁধিতেছি বসি সংকল্প নূতন অন্তরে আমার, সংসারে ফিরিয়া গিয়া হয়তো কখন ভুলিব আবার। তখন কঠিন ঘাতে এনো অশ্রু আঁখিপাতে অধমের করিয়ো বিচার। আজি নব-বরষ-প্রভাতে ভিক্ষা চাহি মার্জনা সবার। আজ চলে গেলে কাল কী হবে না-হবে নাহি জানে কেহ, আজিকার প্রীতিসুখ রবে কি না-রবে আজিকার স্নেহ। যতটুকু আলো আছে কাল নিবে যায় পাছে, অন্ধকারে ঢেকে যায় গেহ– আজ এসো নববর্ষদিনে যতটুকু আছে তাই দেহ। বিস্তীর্ণ এ বিশ্বভূমি সীমা তার নাই, কত দেশ আছে! কোথা হতে কয় জনা হেথা এক ঠাঁই কেন মিলিয়াছে? করো সুখী, থাকো সুখে প্রীতিভরে হাসিমুখে পুষ্পগুচ্ছ যেন এক গাছে– তা যদি না পার চিরদিন, একদিন এসো তবু কাছে। সময় ফুরায়ে গেলে কখন আবার কে যাবে কোথায়, অনন্তের মাঝখানে পরস্পরে আর দেখা নাহি যায়। বড়ো সুখ বড়ো ব্যথা চিহ্ন না রাখিবে কোথা, মিলাইবে জলবিম্ব প্রায়– একদিন প্রিয়মুখ যত ভালো করে দেখে লই আয়! আপন সুখের লাগি সংসারের মাঝে তুলি হাহাকার! আত্ম-অভিমানে অন্ধ জীবনের কাজে আনি অবিচার! আজি করি প্রাণপণ করিলাম সমর্পণ এ জীবনে যা আছে আমার। তোমরা যা দিবে তাই লব, তার বেশি চাহিব না আর। লইব আপন করি নিত্যধৈর্যতরে দুঃখভার যত, চলিব কঠিন পথে অটল অন্তরে সাধি মহাব্রত। যদি ভেঙে যায় পণ, দুর্বল এ শ্রান্ত মন সবিনয়ে করি শির নত তুলি লব আপনার ‘পরে আপনার অপরাধ যত! যদি ব্যর্থ হয় প্রাণ, যদি দুঃখ ঘটে– ক’দিনের কথা! একদা মুছিয়া যাবে সংসারের পটে শূন্য নিষ্ফলতা। জগতে কি তুমি একা? চতুর্দিকে যায় দেখা সুদুর্ভর কত দুঃখব্যথা। তুমি শুধু ক্ষুদ্র একজন, এ সংসারে অনন্ত জনতা। যতক্ষণ আছ হেথা স্থিরদীপ্তি থাকো, তারার মতন। সুখ যদি নাহি পাও, শান্তি মনে রাখো করিয়া যতন। যুদ্ধ করি নিরবধি বাঁচিতে না পার যদি, পরাভব করে আক্রমণ, কেমনে মরিতে হয় তবে শেখো তাই করি প্রাণপণ। জীবনের এই পথ, কে বলিতে পারে বাকি আছে কত? মাঝে কত বিঘ্নশোক, কত ক্ষুরধারে হৃদয়ের ক্ষত? পুনর্বার কালি হতে চলিব সে তপ্ত পথে, ক্ষমা করো আজিকার মতো– পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত। ওই যায়, চলে যায় কালপরপারে মোর পুরাতন। এই বেলা, ওরে মন, বল্ অশ্রুধারে কৃতজ্ঞ বচন। বল্ তারে– দুঃখসুখ দিয়েছ ভরিয়া বুক, চিরকাল রহিবে স্মরণ, যাহা-কিছু লয়ে গেলে সাথে তোমারে করিনু সমর্পণ। ওই এল এ জীবনে নূতন প্রভাতে নূতন বরষ– মনে করি প্রীতিভরে বাঁধি হাতে হাতে, না পাই সাহস। নব অতিথিরে তবু ফিরাইতে নাই কভু– এসো এসো নূতন দিবস! ভরিলাম পুণ্য অশ্রুজলে আজিকার মঙ্গলকলস।